হার্ট এটাক হলে এখন পর্যন্ত দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে, যে কারণে এটাক টা হয়েছে মানে হার্টের ব্লক। সেটা খুলে দেয়া।
আর ব্লক খোলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে এনজিওগ্রাম করে ব্লকের মধ্যে রিং লাগানো। হার্ট এটাকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে রিং লাগানোর উত্তম সময়।এই সময়ের মধ্যে রিং লাগাতে পারলে এটাকের কারণে নষ্ট হতে থাকা হার্টের মাসলগুলোর অনেকটাই রক্ষা পায়।
আর হার্ট এটাকের সাথে সাথে রিং লাগানোর প্রক্রিয়াকে বলে প্রাইমারী পিটিসিএ( Primary PTCA)।
আমি এটা নিয়ে বিশদ লিখবো,তার আগে রিং জিনিসটা কি,তা নিয়ে ছোট্ট আলোচনা।
তো আসুন জেনে নিই....
★★★রিং জিনিসটা আসলে কি?
-হার্টের রিং কে বলতে হবে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিস্কারগুলোর একটা।এটা বিভিন্ন ধাতুর তৈরী খুবই সূক্ষ তারজালির মত, গ্রামে ছোট গাছগুলোকে রক্ষার জন্য বাঁশের তৈরি যে ঘেরাও দেয়া হয় অনেকটা তেমন আকৃতির জিনিস।
যেখানে হার্টে ব্লক হয়।ব্লক বরাবর এই জিনিসটা বসিয়ে এটার ভিতরে একটা বেলুন দিয়ে বেলুনটাকে ফুলানো হয়।ফলে রিংটা বড় হয়ে ব্লকটাকে খুলে দেয়।আর রক্ত চলাচল শুরু হয়।
★★★রিং কোনটা ভালো?
-দুই ধরণের রিং পাওয়া যায়।
১/একটাতে শুধু ধাতব পদার্থ থাকে। যেটাকে বলে বিএমএস (BMS).
২/আরেকটাতে ধাতুর উপরে মেডিসিন দেয়া থাকে,যেটাকে বলে ডিইএস(DES).
BMS এর চেয়ে DES ভালো।সাধারণত আমরা DES ব্যবহার করি।
★★★রিং লাগালে কি ঔষধ খেতে হয়?
আসলে হার্ট এটাক বা হার্টে রক্তপ্রবাহে সমস্যা আছে এমন সব রোগীকেই সারাজীবন কিছু ঔষধ খেয়ে যেতে হয়।রিং লাগালেও এগুলো খেতে হবে।তবে একটা সময় পরে ঔষধ কিছুটা কমানো যায়।
★★★রিং কখন লাগাতে হয় বা কখন লাগালে ভালো?
আসলে রিং লাগানোর উত্তম সময় হচ্ছে হার্ট এটাকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে লাগানো।যত তাড়াতাড়ি রিং লাগানো যায় তত কার্যকর।রিং লাগানোর আরেক নাম স্ট্যান্টিং।পদ্ধতিটাকে বলে পিসিআই(PCI)।
যদি হার্ট এটাকের সাথে সাথে ব্লক খোলার কোন ঔষধ না দিয়েই রিং লাগানো হয় তবে এটাকে আমরা বলি প্রাইমারী পিসিআই।
এখন পর্যন্ত হার্ট এটাকের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা পিসিআই।
যদি সাথে সাথে প্রাইমারী পিসিআই করা না যায় তাহলে কিছু ঔষধ আছে,এগুলো দিয়ে ব্লক খোলার চেষ্টা করা হয়,এগুলোতে ব্লক খুলুক বা খুলুক এরপর এনজিওগ্রাম করে ব্লক থাকলে রিং পরানো যায়,যেটাকে বলে ফার্মাকো-ইনভেসিভ পিসিআই। এই দুইটাতেই রোগীর লাভ বেশি। কিন্তু আমাদের রোগীরা সময়মত আসে না। আসলেও গড়িমসি করে।
তারা প্রথমে ঔষধ দিতে বলে। কিছুটা সুস্থ্য হয়ে বাড়ি যায়। পরে যখন আবার এটাক বা ব্যথা হয় তখন রিং লাগাতে আসে। ততদিনে খুব বেশি আসলে লাভ হয় না।
#দ্বিতীয়তঃ
যাদের দীর্ঘমেয়াদী বুক ব্যথা,বা অনেক দিন আগে হার্ট এটাক ছিল,অল্প পরিশ্রমেই ব্যথা শুরু হয়। বুকে ব্যথার সব ওষুধের পরও ব্যথা না কমে।কিংবা প্রথম /দ্বিতীয় স্টেজেই ইটিটি পরীক্ষা পজিটিভ হয়।
এসব রোগীর এনজিওগ্রাম করে যদি বামপাশের মূল রক্তনালীতে ৫০% এর বেশি বা অন্য রক্তনালীগুলোতে ৭০% এর বেশি ব্লক থাকে,তখন ও রিং লাগাতে হবে।
★★★রিং না লাগিয়ে কি শুধু ঔষধ দিয়ে হার্ট এটাকের চিকিৎসা হয়?
-হয়।তবে আমাদের দেশে যে ইনজেকশনগুলো ব্যবহার করা হয়,সেগুলো সঠিক সময়ে দিলেও শুধু ইনজেকশন দিয়ে হার্ট এটাকে ব্লক খোলার সম্ভাবনা ৬০-৭০%।দেরি হলে এর সম্ভাবনা আরো কমে যায়।
এগুলো আসলে হার্ট এটাকে জলীয় চিকিৎসা, আধুনিক বিশ্বে এসব "বনসাই"চিকিৎসা দিন দিন কমে আসতেছে।
★★★তাহলে হার্ট এটাক হলে কি করতে হবে?
-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ভর্তি হয়ে এনজিওগ্রাম, ব্লক থাকলে রিং।
সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে ইনজেকশন বা জলীয় চিকিৎসা।
★★★কোথায় রিং পরানো যায়?
ঢাকার বাইরে সরকারী মেডিকেল কলেজের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ক্যাথল্যাব ( এক ধরনের অপারেশন থিয়েটার,যেখানে হার্টের বিভিন্ন ইন্টারভেনশন হয়) আছে।এগুলো রিং পরানো হয়।তাছাড়া ঢাকা,চট্টগ্রাম,সিলেট,খুলনা এবং দিনাজপুরে বেসরকারী হাসপাতালেও করা যায়।
★★★ কত পার্সেন্ট ব্লক থাকলে রিং লাগাতে হয়?
হার্টের মূল রক্ত নালী দুইটা।
১/একটা টা বাম পাশের প্রধান রক্তনালী যেটার আবার দুইটা শাখা।
২/আরেকটা ডানপাশের রক্তনালী।
এই তিনটা রক্তনালীর যে কোনটা বা এগুলোর মোটা কোন শাখা তে সাধারণত ৭০% বা তার বেশি ব্লক হলে রিং লাগাতে হয়।এর নীচে হলে রিং লাগবে না,ঔষধে চলবে।
তবে বামপাশের মূল রক্তনালীতে ৫০ % ব্লক হলেও রিং লাগবে।
তাহলে বামপাশের মূল রক্তনালীতে ৫০%,এর শাখা তে ৭০%,ডানপাশেরটা বা তার মোটা কোন শাখাতে ৭০% হলে রিং লাগাতে হবে।তবে স্পেশাল কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে।
যদি তিনটা রক্তনালীতেই ব্লক থাকে,যেগুলোতে রিং লাগানো যাচ্ছে না বা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দুই বা তিনটা বড় ধরণের ব্লক থাকে সেক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশন ভালো।
★★★খরচ কেমন?
রিং পরানোর আগে এনজিওগ্রাম( রক্তনালীর পরীক্ষা) করে দেখতে হয় ব্লক আছে কিনা এবং রিং লাগবে কিনা?
শুধু এনজিওগ্রামে সরকারী হাসপাতালে ঔষধসহ সব মিলিয়ে খরচ ১০০০০-১১০০০ টাকা।প্রাইভেটে ২০০০০-২২০০০।
রিং লাগলে মোটামুটি ভালোমানের রিংয়ের ক্ষেত্রে ১ টা রিং সরকারী হাসপাতালে ৭০০০০-১০০০০০(সত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ) টাকা।
বেসরকারীতে ক্ষেত্রভেদে ১৮০০০০-২৫০০০০(এক লক্ষ আশি হাজার থেকে আড়াইলক্ষ)টাকা।
এরমধ্যে কর্পোরেটগুলোতে বেশি।
চট্রগ্রামে প্রাইভেটেও ১৭৫০০০-২০০০০০ টাকার মধ্যে হয়ে যায়। রিং লাগানোর পরও ৩ -৪ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।ঐ খরচ ও এই প্যাকেজের মধ্যে।
আর রিংয়ের দাম সরকারীভাবে নির্ধারিত।রোগীর পছন্দ অনুযায়ী ৬৩০০০ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে।
★★★চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এনজিওগ্রাম বা রিং পরানো হয়?
চট্টগ্রাম মেডিকেলে যতগুলো ওয়ার্ড আছে তারমধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ওয়ার্ড কার্ডিওলজি।
এখানে এনজিওগ্রাম,রিং পরানো,পেসমেকার লাগানোসহ হার্টের আরো অনেক আধুনিক ডিভাইস লাগানো হয়।
দেশবরেণ্য কয়েকজন অভিজ্ঞ কার্ডিওলজিষ্ট এখানে নিয়মিত এসব প্রসিডিওর করেন।খরচ ও অনেক কম।
★★★রিস্ক কেমন?
পৃথিবীর সব চিকিৎসায় রিস্ক আছে।হার্ট এটাকের রোগীর রিং না পরালে যে রিস্ক, রিং পরানো তার চেয়ে অনেক অনেক কম রিস্কি।
★★★তাহলে হার্ট এটাক হলে রিংই ভালো?
শেষকথা হচ্ছে হার্ট এটাকের পর যারা সঠিক সময়ে রিং পরানোর মত সুযোগ পান বা পরাতে পারেন তাদের মত সৌভাগ্যবান আর হয় না।